স্বামী বিবেকানন্দ, তিনি সন্ন্যাসী, সুবক্তা, দুরন্ত লেখক, অনন্য সাধারণ নেতা। কিন্তু সর্ব্বপরি তিনি উত্তর কলকাতার সিমলে পাড়ার বাঙালি। আর বাঙালি মাত্রেই ভোজনরসিক এই ‘দুর্নাম’ তো বিশ্ব বিদিত। তাই সিমলে পাড়ার দত্ত বাড়ির সুসন্তানটিও সে তার ব্যতিক্রম নন তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
সন্ন্যাসী হওয়ার অনেক আগে ভোজনরসিক এই নরেন্দ্রনাথ দত্তের যাত্রা আরম্ভ হয়েছিল দত্ত বাড়িতে বাসমতি চালের পোলাও ও মাংস সহযোগে। তাঁর মাংসপ্রীতির গল্পের সন্ধান মেলে পরবর্তীতে তাঁর মেজো ভাই মহেন্দ্রনাথ দত্তের লেখায়। এক লেখায় জানা যায়, তরুণ নরেন্দ্রনাথ মাংসের বাজার থেকে বিশেষ ব্যবস্থায় মাংস ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে একাধিক পাঁঠার মুড়ো সংগ্রহ করতেন। একাধিক ডাল সেই মুড়ো সহযোগে ফুটিয়ে প্রস্তুত হত ব্যঞ্জন। সঙ্গে থাকতো খান দশ বারো রুটি। তা দিয়ে নরেন নিজের বৈকালিক জলযোগ সারতেন। আসলে মাংসের প্রতি স্বামীজির যে বিশেষ দুর্বলতা ছিল তা বারবার প্রকাশ পেয়েছে। এক সময়ে মুরগির মাংসের বাঙালির হেঁশেলে প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু দুরন্ত নরেনের সেই আক্ষেপ পূরণ হত কলকাতার বিভিন্ন রেস্তোরাঁয়। বিবেকানন্দের মাংসপ্রীতি সম্বন্ধে স্বামী অভেদানন্দ লিখেছেন, ‘সে দিন নরেন বলিল, চল আজ তোদের কুসংস্কার ভাঙিয়া দিই…। সন্ধ্যার সময় কাশীপুর বাগান হইতে পদব্রজে আমরা নরেনের সঙ্গে বিডন স্ট্রিটে বর্তমানে যেখানে মিনার্ভা থিয়েটার, তাহার নিকটে পীরুর দোকানে উপস্থিত হইলাম। নরেন ফাউলকারি অর্ডার দিল…। রাত্রে কাশীপুরে ঠাকুর জিজ্ঞাসা করিলেন, কোথায় গিয়েছিলি? আমি বলিলাম কলিকাতার বিডন স্ট্রিটে পীরুর দোকানে।… জানতে চাইলেন কী খেলি? আমি বলিলাম মুরগির ডালনা। শেষ পর্যন্ত ঠাকুর ঈষৎ হাস্য করিয়া বলিলেন, বেশ করেছিস।’ এই সময়েই কোন একজন নরেন্দ্রনাথের অতিরিক্ত মুরগি-প্রীতি বিষয়ে ঠাকুর রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের কাছে নালিশ করেন। ঠাকুরের জবাব ছিল, “খেয়েছে তো কী হয়েছে। তুই যদি রোজ হবিষ্যিও খাস, আর নরেন যদি রোজ হোটেলে মাংস খায়, তা হলেও তুই নরেনের সমান হতে পারবি না।” এই মাংসপ্রীতি বজায় ছিল সন্ন্যাস জীবনেও। সেই জন্যই নিজের সন্ন্যাস জীবনে বারবার কটাক্ষের স্বীকার হয়েছেন তিনি। এমনকি তাঁর মৃত্যুর পর তৎকালীন প্রখ্যাত ‘অমৃৎবাজার পত্রিকা’ শিরোনাম দিয়েছিল, ‘এ মিট ইটিং স্বামী’!
- Advertisement -
বাঙালির ছেলের আমিষের সঙ্গে নিরামিশেও যে বিশেষ রুচি থাকবে তা বলাই বাহুল্য! সেই নিরামিষ রান্নার লোভে প্রায়ই বেলুড় থেকে নিজের সাঙ্গপাঙ্গ গুরুভাইদের নিয়ে তিনি হানা দিতেন তাঁর দিদিমার হেঁশেলে। বাল্যে নরেন নিজের ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন ‘পেটুক সংঘ’। তাঁর বিশেষ আকর্ষণ ছিল জলখাবারে কচুরি। এতটাই যে কোন একজনের প্রশ্নের উত্তরে নিজের সাধন সম্প্রদায় সম্পর্কে রহস্য করে বলেছিলেন, তিনি ‘কচুরি সম্প্রদায়’ ভুক্ত। আবার খিচুড়ি ও ঝাল লঙ্কার প্রতি ছিল তাঁর অমোঘ আকর্ষণ। তাঁর সঙ্গে তর্কে বসে লঙ্কা খেতে গিয়ে অনেকেই নাকের জলে চোখের জলে হয়েছেন। আর খিচুড়ি ছিল বোধহয় তাঁর জাতীয় খাদ্য। আসলে সন্ন্যাস গ্রহণের পর কঠোর ব্রহ্মচর্য পালনের সময় ভিক্ষালব্ধ চাল, ডাল, সবজিতে খিচুড়িই ছিল দিনে একবার ক্ষুন্নিবৃত্তির প্রশস্ত পথ। একবার বেলুড় এ কাঙালী ভোজনের আয়োজন হয়েছিল। বিদেশ থেকে মঠে ফিরছিলেন স্বামীজী। দূর থেকেই খিচুড়ির গন্ধ নাকে যেতেই গেট খোলার জন্যও অপেক্ষা করেননি তিনি। সোজা পাঁচিল টপকে কাঙালীদের সঙ্গে পাতা নিয়ে পঙ্গক্তি-ভোজনে বসে গিয়েছিলেন খিচুড়ি চাখতে।
- Advertisement -
আবার শুধু খেতে নয় খাওয়াতেও ভালো বাসতেন এই সর্বত্যাগী। নিজের ভাবশিষ্যা নিবেদিতা প্রায়ই বেলুড়ে নেমতন্ন করে নিজে রেঁধে বেড়ে খাওয়াতেন তিনি। তাঁর রান্নার হাতটিও যে সরেস ছিল তা বারবার বিভিন্ন গ্রন্থে ও স্মৃতিচারণে উল্লিখিত হয়েছে। নিজের বিদেশ যাত্রা কালে একদিক মার্কিন শিষ্য, ভক্তদের বাড়িতে অনেক সময়েই নিজের হাতে বিভিন্ন পদ রেঁধে খাওয়াতেন তিনি। আর বিদেশে ভারতীয় মশলার আকাল বিবেচনা করে সবসময় নিজের সঙ্গে রাখতেন মশলার কৌটো। খাদ্য রসিক ও রন্ধন পটুত্বের প্রমান তিনি রেখে যান জীবনের অন্তিম দিনেও। সেই বারে জুলাইয়ের প্রথম বর্ষার ইলিশ উঠেছিল গঙ্গায়। ইলিশ কেননা তিনি। তারপর শারীরিক ভাবে অসুস্থ হওয়া সত্ত্বেও নিজেই বসে যান ইলিশ রাঁধতে। ভাজা, ঝাল, ঝোল সহ তৈরি করেন একাধিক পদ। লেকচার দিতে বিশেষ পছন্দ করতেন তাই রান্না বিষয়েও রান্না করতে করতে গুরুভাই শিষ্যদের লেকচার দেন। তারপর ভাতের সঙ্গে ইলিশের একাধিক পদ দিয়ে সেরেছিলেন অন্তিম মধ্যহ্নভোজন। সেই দিন নিজের অতিরিক্ত খাওয়া নিয়ে মজা করে বলেছিলেন, একাদশী করে তাঁর খিদেটা বেশ বেড়েছে।
খাওয়া তো বিভিন্ন রকমের আছে। তবে গুরুভোজনের পরে আরেকটি খাওয়া রসিকদের কাছে বিশেষ সুখপ্রদ। অবশ্য এটিকে খাওয়া না বলে ‘পান’ বলাই বাঞ্চনীয়। কথা হচ্ছে ‘ধূম্রপান’ নিয়ে। গুরু ভোজনের পরে স্বামীজির ধূমপান ছিল আবশ্যক। বেশ ছোট বেলা থেকেই তিনি ধূমপায়ী। এমনকি সিমলে পাড়ায় ছোকরা নরেনের পরিচয় ছিল, ‘বাপ-কাকার সামনে তামাক খেয়ে তবলায় চাঁটি মেরে বেড়ানো’ ছোকরা। সন্ন্যাস নেওয়ার আগে দক্ষিণেশ্বরে রাত কাটালে নরেনের ধূমপান বিষয়ে অবহিত ঠাকুর রামকৃষ্ণ নিজের সঙ্গে নরেনেরও গুড়ুক খাওয়ার ব্যবস্থা করতেন। খাওয়ার পরে স্বামীজির এই সুখটান দেওয়ার অভ্যাস বজায় ছিল বরাবর। এবিষয়ে ধূমপানে অনভ্যস্ত তাঁর গুরুভাই তিনি নিজের স্মৃতিশক্তি ও অনন্য সাধারণ বুদ্ধিমত্তা বিষয়ে উল্লেখ করে প্রলুব্ধ করার জন্য বলতেন, গুড়ুক খাওয়ার জন্যই তাঁর মাথা নাকি এত সাফ। এই বিষয়ে স্বামীজির জীবনের এক ঘটনা তিনি পরবর্তীতে উল্লেখ করে কষিয়ে থাপ্পড় দিয়েছেন অস্পৃশ্যতার অজ্ঞতাকে। সন্ন্যাস গ্রহণের পর পরিব্রাজক কালে একবার স্বামীজি হেটে ঘোরার সময় এক মাঠের পাশে একটি লোককে হুঁকো সাজিয়ে তামাক খাওয়ার আয়োজন করতে দেখেন। ভিতরের ধূমপায়ী প্রলুব্ধ হয়ে ওঠে। লোকটার কাছে গিয়ে একটু তামাক খাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। গেরুয়া বস্ত্র দর্শনে সভয়ে পিছিয়ে যান সেই লোক। কুন্ঠিত ভাবে বলেন, মহারাজ, আমি যে ‘ভাঙ্গি’ (মেথর)! তখন স্বামীজিও বিফল হয়ে হাঁটতে শুরু করেন। কিছু দূর আসার পরই তিনি চমকে ওঠেন। তাঁর মনে নিজের প্রতিই জিজ্ঞাস্য জাগে যে, তিনি একজন সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী। জাত-পাত, ধর্ম, লোকাচার সবকিছুর উর্ধ্বে। তার কাছে যে নরই নারায়ণ। এই তিনি কি করছিলেন! ফিরতি পথ ধরেন। সেই ‘ভাঙ্গি’র কাছে ফিরে গিয়ে আবার হুঁকো চান। সেই লোক বলেন, মহারাজের সাথে তামাক খেলে তাঁর পাপ লাগবে। কিন্তু তাঁকে বিভিন্ন ভাবে আশ্বস্ত করে সেই হুঁকোতেই মনের সুখে তামাক টানেন। অবশ্য বিশুদ্ধবাদী ও বিরুদ্ধবাদীর দল একে ধূমপায়ীর ‘ছলনা’ বলে কখনও বঙ্কিম কটাক্ষ করলেও ‘বেরসিক’দের ‘রসিক জনে’র উপেক্ষাই শ্রেয়।