

✒️শুভব্রত রানা: ‘না’। এই শব্দটির গ্রহণযোগ্যতা বোধহয় আজ ফিকে। অন্ততঃ বর্তমান সংবাদের পর্যায়ক্রম দেখলে তাই মনে হয়। ‘না’ আসলে একটা প্রতিবাদ। বিরুদ্ধাচরণ। আর আমরা- সমাজবদ্ধ মানুষ মুখে যাই বলি এই প্রতিবাদ এই বিরুদ্ধাচরণকে ঠিক মেনে নিতে পারি না।
ক্লাবের মাত্রাতিরিক্ত চাঁদাকে না বলো, তুমি অসামাজিক।
বাড়িতে না বলো, তুমি সংসারে থাকার অযোগ্য।
পার্টিকে না বলো, তুমি বিরোধীদলের।
প্রেমিকাকে না বলো, তুমি দায়িত্বজ্ঞানহীন প্রেমিক।
আর ভুল করেও যদি অফিসের বসকে না বলো, তবে তোমার চাকরির ঘ্যাচ মুণ্ডু ঘচাং।
তাই আমরা নিজেদের সঠিক নিয়মে পরিশীলিত করছি। সর্বদা হেঁট মুণ্ডু ‘হ্যাঁ’।
না! সেটা আবার কি! বলতে আছে?!
সেখানে ‘না’ শব্দটি যদি কোনো নারীর মুখ থেকে আসে তাহলে তো কথাই নেই। বিশ্বসংসার রসাতলে। মেয়ে ‘না ‘ বলছে! ওরা তো দ্বিতীয় সারির জীব। না বলে কি করে?! অতএব বল প্রয়োগ। তাই ‘না’ এর বলপূর্বক ‘হ্যাঁ’ এ উত্তরণের জান্তব প্রকাশ আরও একটি ধর্ষণ।
সত্যি কত সাধারণ শব্দ। ধর্ষণ! একসময় শব্দটি পড়লে বা শুনলেও গা ঘিন ঘিন করে উঠত। আজ কি অবলীলায় লিখে ফেলছি। বিশ্বাস করুন একটুও অস্বস্তি হচ্ছে না। গা সওয়া হয়ে গিয়েছে মনে হচ্ছে।
ও, ধর্ষণ হয়েছে। আচ্ছা।
ছোটবেলায় নতুন জুতো পড়লে পা ছড়ে গিয়ে খুব ব্যথা হত। তারপর সেই জুতো পড়তে পড়তে পায়ে কড়া পড়ে আর কোন অনুভূতিই থাকতনা। ভয় হয়। এই বারংবার ধর্ষণের ঘটনা যদি আমাদের অনুভূতিগুলোকেই নষ্ট করে দেয়?! রাগ দুঃখ হতাশা বিরক্তি কোনটাই আর অনুভব করবো না।
রোজ ঘটছে, ঘণ্টায় ঘন্টায় ঘটছে, মিনিটে মিনিটে ঘটছে ধর্ষণ। কারন একজন নারী ‘না’ বলেছিল।
কোন মহিলা ‘সজ্ঞানে’ না থাকলে অথবা তার ‘না’এর বিরুদ্ধে ঘটলে যে কোন যৌনসংসর্গই ধর্ষণ। এমনকি সেই মহিলা আপনার বিয়ে করা বউ হলেও। হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন। যদিও বিশ্বের বৃহত্তম গনতন্ত্র আজও এই নিয়ে দ্বিধাগ্রস্থ৷ ভারতীয় পিনাল কোড, সেকশন ৩৭৫ এ একটি প্রশ্নযোগ্য ‘ব্যতিক্রম’ গুঁজে দিয়ে মৌন। আর আমরা প্রতিনিয়ত পৌরুষের দম্ভে এক অসহায় নারীর ‘না’এর বাধা ভাঙছি। তার নারীত্বকে আসুরিক হুঙ্কারে জয় করে ধর্ষণের বিজয় উৎসব করছি।
জীবন অভিজ্ঞ গুরুজনেরা বলেন, নারীর না মানেই হ্যাঁ। কিন্তু প্রেমপূর্ণ ‘না’ আর সিদ্ধান্তমূলক ‘না’ এর তফাৎটা বোঝা দরকার। যে পুরুষ এই তফাৎকে হৃদয়ঙ্গম করতে পারেনি সে আর যাই হোক পৌরুষ আয়ত্ত করেনি। আমাদের ভণ্ড সমাজ অবশ্য উল্টো বোঝে। এখানে পৌরুষ বলতে বোঝায় দুই পায়ের মাঝে কয়েক ইঞ্চির মাংসল পেশি। ভদ্রতা-সভ্যতা চুলোয় যাক।
ঐ মেয়েটার বড্ড দেমাক। সব দম্ভ মুচড়ে দেব। নিদেনপক্ষে অ্যাসিড আছে তো। জ্বালিয়ে দেব রূপের দেমাক। দেখি কেমন মুখ দেখাবে। অথবা নির্জন রাস্তায় পথ আটকাবো। তারপর তো গাড়ি আছে। উঠিয়ে নিলেই ঝামেলা শেষ। কে আর দেখছে। শেষে ফেলে দিলেই হল প্রাণহীন নগ্ন শরীরটা কোন ঝোপেঝাড়ে। তবেই আমি পুরুষ বটে।
কারণ মেয়েটা ‘না’ বলেছিল।
একজন নারীর ‘না’ বলার অধিকার আছে। তার ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের অধিকার, সাংবিধানিক অধিকার, নাগরিক অধিকার। এই সত্যটা উপলব্ধির বড্ড প্রয়োজন। যারা ভালো কথায় বুঝবে ঠিক আছে নাহলে, সমাজের ও রাষ্ট্রের উচিৎ তাকে সঠিক ‘মুষ্টিযোগে’ বোঝানো।
বোঝানোই শেষ কথা নয়। প্রয়োজন একজন মানুষের ব্যক্তিগত স্বাধীন সিদ্ধান্তের প্রতি সন্মান প্রদর্শন।
এক নারীর ‘না’এর প্রতি সন্মান প্রদর্শন।।