World Cup 2023 : শামির স্বপ্নময় উত্থান : এভাবেও ফিরে আসা যায়

World Cup 2023 : শামির স্বপ্নময় উত্থান : এভাবেও ফিরে আসা যায়

‘কতটা পথ পেরোলে তবে পথিক হওয়া যায়?’ – উত্তরপ্রদেশের মোরাদাবাদ থেকে কলকাতার টাউন ক্লাবের পথটা কি বড্ড কম? কলের শহর কলকাতা নাকি সহজেই আপন করে নেয় সবাইকে! কিন্তু সেদিন উত্তরপ্রদেশের অচেনা – অজানা – অখ্যাত ছেলেটা কলকাতায় পা রেখেই বুঝে গিয়েছিল এই শহরে টিকতে গেলে তাকে লড়তে হবে। না, লড়াইয়ে কোনদিন অনীহা নেই তার। বাইশ গজের স্বপ্নে বিভোর হয়ে যে লড়াইটা এতদিন ছেলেটা লড়ত মাঠের মধ্যে সেই লড়াইটাই এবার ছড়িয়ে পড়ল মাঠের বাইরেও। পকেটভর্তি মেঠো গন্ধকে সম্বল করে একটা দুরন্ত স্বপ্নের পিছনে ছুটে চলেছিল ছেলেটা। তারপর? ২২.৩৮ সেন্টিমিটারের একটা বলকে সম্বল করে শুধু প্র্যাকটিস, প্র্যাকটিস আর প্র্যাকটিস। কারণ ছেলেটা ধ্রুব সত্যের মতো বিশ্বাস করতো একটা কথা – ‘Practice makes a man perfect.’ তোমার সামনে ব্যাটার আর তিনটে উইকেট। অন্যদিকে তোমার হাতে বল, এটাই সত্যি। বাকি বিশ্বচরাচর ডুবে মরুক স্বখাতসলিলে। তাকে থোড়াই কেয়ার করে সে। বাকি সবকিছু মিথ্যা, শুধু ওই ২২.৩৮ সেন্টিমিটারের বলটা সত্যি। মিথ্যা তাদের বাড়ির সামনের জুঁইফুলের গাছটা, মিথ্যা মনকেমন করা বিকেলবেলা, মিথ্যা ইস্কুল কেটে প্রেয়সীকে একঝলক দেখার ইচ্ছে অথবা মায়ের হাতের আদরমাখানো ডাল – রুটি। তার হাতের ইনসুইংটা যখন ব্যাটারকে বোকা বানিয়ে ভেঙে দেয় মিডল স্ট্যাম্প অথবা আউটসুইংটা যখন প্রতিপক্ষের ব্যাটের কানায় আলতো চুম্বন করে জমা পড়ে কিপারের হাতে তখন ছেলেটার চোখের সামনে ভেসে ওঠে একটা স্বপ্ন। দর্শকভর্তি একটা স্টেডিয়াম, বিশ্বকাপের সামনে দাড়িয়ে জাতীয় সঙ্গীত গাইছে সে। শুধু সে নয় অবশ্য, ওর সঙ্গে আরও দশজন। তারপরেই ধড়মড়িয়ে উঠে বসে ছেলেটা – ঘুমচোখে দেখে ঘড়ি জানান দিচ্ছে প্র্যাকটিসের সময় হয়ে এল।

সেদিন ক্রিকেটকে ভালোবেসে যে ছেলেটা নিজের ভিটেমাটি ত্যাগ করেছিল তার নাম মহম্মদ শামি। কলকাতার টাউন ক্লাবেই যার প্রথম পেশাদার ক্রিকেটের হাতেখড়ি। সেদিন কি কেউ ভাবতে পেরেছিল সেদিনের কিশোর একদিন দেশের হয়ে বিশ্বকাপের ময়দানে মাত্র ৩ ম্যাচ খেলে ১৪ টা উইকেট নেওয়ার মতো বিরল কৃতিত্বের নজির গড়বে? অথচ এমন একজন বোলারকে প্রথম কয়েকটা ম্যাচে ডাগ আউটে বসিয়ে রাখা হয়েছিল। তাহলে কী এবার সেই উপেক্ষার জবাব দিলেন শামি? নাকি নীরবে নিজের দায়িত্ব পালন করে গিয়ে আরও একবার বুঝিয়ে দিলেন তিনি কথায় নয় কাজে বিশ্বাস করেন? অবশ্য এই প্রথম নয়, এর আগেও বারবার শামিকে দল থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। কখনও চোটের কারণে কখনও বা ব্যাটের হাত ভালো নয় এই অজুহাতে। কিন্তু শামি হেরে যাননি, কারণ শামিরা হারেননা। তারা জেতেন সবসময়। সেটা বাইশ গজের বিশ্বযুদ্ধ হোক অথবা সংসারসীমান্তের লড়াই। তাই আবারও প্র্যাকটিস, প্র্যাকটিস এবং প্র্যাকটিস। যতবার দল থেকে বাদ পড়েছেন ততবার নিজেকে আরও ক্ষুরধার করে ফিরে এসেছেন তিনি। জবাব দিয়েছেন উপেক্ষার।

সালটা ২০১৫। গোটা ভারতবর্ষ এতদিন দেখেছিল শামির স্বপ্নের উত্থান। ২০১৫ বিশ্বকাপের পরে সেই শামি যেন হারিয়ে যেতে বসলেন। চোটের কারণে শামি তখন দলের বাইরে। এরপর? দীর্ঘ আঠেরো মাসের অপেক্ষা। এই আঠেরো মাস যেন আঠেরো বছরের সমান শামির কাছে। সেইসময় তিনি তিন তিনবার আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলেন। কিন্তু জীবনদেবতা বোধহয় চাননি এখানেই শেষ হোক মোরাদাবাদ এক্সপ্রেসের যাত্রা। তাই প্রতিবারই তিনি শামিকে ফিরিয়ে এনেছেন মৃত্যুর দরজা থেকে। এতকিছুর পরেও কিন্তু শামি ফিরেছেন বারবার। ময়দানের সবুজ ঘাস তার নিজের সন্তানকে চিনে নিয়েছে আবারও।

তবে এরপরেও কিন্তু শামির জীবনে সবসময় তাড়া করে বেরিয়েছে বিতর্ক। ২০১৮ সালে শামির নামে ম্যাচ ফিক্সিংয়ের অভিযোগ তোলেন তার স্ত্রী। যদিও ভারতীয় বোর্ড সেই অভিযোগকে খুব একটা গুরুত্ব দিতে চায়নি। শামি হারেননি। কারণ তিনি হারতে জানেন না। নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করে আবারও বাইশ গজে ফিরেছিলেন তিনি। এরপর শামি ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে বিব্রত হয়েছেন বারংবার। তার স্ত্রী হাসিন জাহান শামির বিরুদ্ধে গার্হস্থ্য হিংসার অভিযোগ জানিয়েছেন, এমনকি নিজের দাদাকে দিয়ে স্ত্রীকে ধর্ষণে প্ররোচনা দেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল তাকে নিয়ে। বধূ নির্যাতনের মামলায় সম্প্রতি আলিপুর আদালতে হাজিরা পর্যন্ত দিতে হয়েছে তাকে।অথচ শামির মুখের সেই অমায়িক হাসি মিলিয়ে যায়নি। জীবনে এত চড়াই – উৎরাই পেরিয়েও বিশ্বকাপে ১৪ ম্যাচ খেলে ৪৫টি উইকেট শিকার করলেন মহম্মদ শামি। একদিনের বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারীদের তালিকায় অষ্টম স্থানে উঠে এলেন ভারতীয় পেসার। কারণ শামিরা হারতে জানে না, কারণ শামিরা লড়তে জানে।

২০১৯ বিশ্বকাপে আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে হ্যাটট্রিক করে শামি জবাব দিয়েছিলেন সমস্ত উপেক্ষার। গতকাল শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে পাঁচ উইকেট নেওয়ার পরেও বেশকিছু বিরল কৃতিত্বের অধিকারী হলেন তিনি। এতদিন পর্যন্ত বিশ্বকাপে ভারতের হয়ে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী ছিলেন জাহির খান এবং জাভাগল শ্রীনাথ। তাদের উইকেট সংখ্যা ছিল ৪৪। শামি গতকাল টপকে গেছেন এই দুই কিংবদন্তিকে। তার উইকেট সংখ্যা ৪৫। আবার একদিনের ক্রিকেটে ভারতের হয়ে সবচেয়ে বেশিবার পাঁচ উইকেট শিকার করলেন শামি। এর আগে হরভজন সিং এবং জাভাগল শ্রীনাথ ৩বার করে পাঁচ উইকেট নিয়েছিলেন। শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে ৫ উইকেট নিয়ে তাঁদের টপকে গেলেন শামি। এবারের বিশ্বকাপে রীতিমতো ফুল ফুটিয়ে চলেছেন তিনি। মাত্র তিন ম্যাচে ১৪ টি উইকেট। অবিশ্বাস্য। ওডিআই ক্রিকেটে দ্বিতীয়বার টানা তিনটি ম্যাচে চার অথবা তার বেশি উইকেট নেওয়ার নজির গড়লেন শামি। এর আগে তিনি ২০১৯ বিশ্বকাপেও তিনি এই রেকর্ড গড়েছিলেন। শামি ছাড়াও এই রেকর্ডের অধিকারী ওয়াকার ইউনিস। তবে বিশ্বকাপের ময়দানে শামির এই রেকর্ড এখনও অক্ষুণ্ণ। বিশ্বকাপে তিন বার পাঁচ উইকেট নেওয়ার রেকর্ডও নিজের নামে করলেন মহম্মদ শামি। তার সামনে এখন শুধু মিচেল স্টার্ক। শামি এরপরেও ভালো পারফর্ম করবেন কারণ তিনি জানেন একটা ম্যাচে অফ ফর্ম তাকে আবার ফেরত পাঠাতে পারে ডাগ আউটে। কিন্তু তিনি তো বলকে কথা বলাতে পারেন। তিনি এসেছেন জিততে, ডাগ আউট তার জায়গা হতে পারে না।

শামিদের মতো কিছুজন আছে বলেই সবকিছুকে তুচ্ছ করে এখনও কিছু দস্যি – দামাল ছেলে স্বপ্ন দেখে। তারা প্রশ্ন করে – ‘ কার তাতে কী? আমরা যদি এই আকালেও স্বপ্ন দেখি?’ শামিদের মতোই কিছু হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালার জন্যই আজও রাস্তার মোড়ে মোড়ে, বা উত্তর কলকাতার অখ্যাত গলির মধ্যে বেচেঁ থাকে ক্রিকেটপ্রেম। কারণ শামিরা প্রমাণ করতে জানেন – ‘ এভাবেও ফিরে আসা যায়।’

হোম
জয়েন গ্রুপ
স্থানীয় খবর
জয়েন গ্রুপ
গুগল নিউজ