রজনীগন্ধা ফুল চাষ – রজনীগন্ধা ফুল পছন্দ করেন না এমন মানুষ খুবই কম। বাঙালির বিয়েবাড়ি তো রজনীগন্ধা ছাড়া ভাবাই যায়না। তাই বাজারে বিয়ের মরশুমে রজনীগন্ধায় হাত দেওয়াও যায় না। রজনীগন্ধা ফুলের গন্দে পাগল কিন্তু দামের কারণে ছোঁয়া বারণ। এমনটা যদি হয় তাহলে চিন্তা কি বাড়িতেই টবে চাষ করে ফেলুন রজনীগন্ধা ফুল। শুনতে অবাক লাগলেও এটা সম্ভব।
জুন মাসের মাঝে এবং জুলায়ের শুরুর দিকে রজনীগন্ধার গাছ লাগানোর সঠিক সময়। রজনীগন্ধা গাছের বাল্ব কিনতে পাওয়া যায় সেগুলি জানুয়ারি বা ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে লাগাতে হবে আর তা নাহলে নার্সারি তে চারাগাছ কিনতে পাওয়া যায় তা কিনলেও হবে। আগস্ট মাস থেকে অর্থাৎ মোটামুটি শীতের শুরুর দিকেই গাছটিতে ফুল ফুটতে শুরু করবে। এই কয়েকটা মাস গাছটির খুব ভালোভাবে পরিচর্যা করতে হবে তাহলেই প্রচুর ফুল হবে।
রজনীগন্ধা ফুল চাষ এর জাত:
ফুলের পাঁপড়ি বা স্পাইকের সারি অনুযায়ী রজনীগন্ধা তিন ভাগে বিভক্ত। সিঙ্গেল, সেমি-ডাবল ও ডাবল। যে সব জাতের ফুলের পাঁপড়ি বা স্পাইক একটি সারিতে থাকে সে সব জাতগুলি সিঙ্গেল শ্রেনীভুক্ত, যে সব জাতে ফুলের পাঁপড়ি দুই বা তিন সারিতে থাকে সে জাতগুলিকে সেমি-ডবল এবং তিন-এর অধিক পাঁপড়ির সারি থাকলে সে জাতগুলিকে ডাবল শ্রেনীর আওতাভুক্ত হিসেবে ধরা হয়ে যায়।
রজনীগন্ধা ফুল চাষ এর প্রয়োজনীয় আবহাওয়া:
উপযুক্ত বৃদ্ধির জন্য আর্দ্র আবহাওয়া এবং গড় তাপমাত্রা ২০০ থেকে ৩০০ সে. হওয়া দরকার। পর্যাপ্ত সূর্যোলোকসহ উপকূলীয় এলাকা ও বর্ষাকাল উৎপাদনের উপযুক্ত সময় । শীতকালে রজনীগন্ধা ফুলের উৎপাদন কমে যায়। তবে সেমি ডবল ও ডবল জাত শীতকালেও ফুল দিতে থাকে।
রজনীগন্ধা ফুল চাষ এর মাটি:
সুনিষ্কাশন ক্ষমতাসম্পন্ন দোআঁশ ও বেলে মাটি রজনীগন্ধা চাষের জন্যে উপযুক্ত। মাটির পিএইচ 6.5-7.5 থাকা এর বৃদ্ধির জন্য আদর্শ মান।
রজনীগন্ধা ফুল চাষ এর জমি প্রস্তুত
লাঙল ও মই দিয়ে চাষ করে মাটি গুঁড়ো করে দৈর্ঘ্যে ৪ মিটার ও প্রস্থে ৩ মিটার জমি কয়েকটি কেয়ারিতে ভাগ করে যাতে দু’সারির কেয়ারির মাঝে জল সেচ বা জল নিকাশের নালা থাকবে। প্রত্যেক কেয়ারিতে ২-৩ সেঃ মিঃ পুরু করে গোবর সার বা কম্পোষ্ট ছড়িয়ে দিয়ে কোদাল দিয়ে ভালো করে মাটির সঙ্গে ঝুরঝুরে করে নিতে হবে ।
এবার কাঠা প্রতি ১ কেজি ইউরিয়া ও ১ কেজি মিউরেট অব পটাশ সার দিয়ে উপরের ১৫ সেঃ মিঃ মাটির সঙ্গে ভালোভাবে মিশিয়ে ফেলতে হবে। এ সমস্ত কাজ চারা লাগাবার অন্তত ১৫ দিন আগে সেরে ফেলতে হবে।
বংশবিস্তার:
রজনীগন্ধা বীজ ও কন্দ উভয় মাধ্যমেই বংশবিস্তার করে থাকে। তবে আমাদের দেশে সাধারণত কন্দ দ্বারাই রজনীগন্ধার চাষ হয়ে থাকে। প্রতিটি গাছের গোড়ায় পেঁয়াজের মত যে বাল্ব পাওয়া যায় তাকে কন্দ বা বাল্ব বলে। পুরাতন গাছের গোড়ায় ঝাড় আকারে অনেক বাল্ব থাকে। মাঝের বাল্বটি বড় হয়। সাধারনত: মাঝারী থেকে বড় আকারের বাল্ব বংশবিস্তারের জন্য ব্যবহার করা হয়। বড় ধরনের বাল্ব থেকে স্বাস্থ্যবান গাছ হয় ও গাছে তাড়াতাড়ি ফুল আসে কিন্তু ছোট বাল্ব থেকে দূর্বল প্রকৃতির গাছ হয় ও দেরীতে ফুল আসে। কন্দ থেকে উৎপন্ন গাছে মা-গাছের সব বৈশিষ্ট্য অক্ষুন্ন থাকে এবং স্বল্প সময়ে গাছে ফুল আসে। শীতকালে কন্দগুলি সাধারণত মাটির নিচে সুপ্ত অবস্থায় থাকে। শীতের শেষে কন্দগুলি লাগানোর জন্য উপযোগী হয়।
কন্দ বা গেঁড়:
পুরোনো রজনীগন্ধার ঝড় উঠালে গোড়ায় থোকা থোকা পেঁয়াজের মতো দেখতে পাওয়া যায় যাকে কন্দ বা গেঁড় বলা হয় এবং এগুলো থেকেই চারা তৈরি হয়। শীতকালে এ কন্দগুলো সুপ্ত অবস্থায় থাকে যা লাগানোর মাসখানেক আগে তুলে ছায়ায় রেখে দিয়ে মোটা কন্দগুলো বেছে নিয়ে লাগাতে হয়।
রোপণ পদ্ধতি
জমি চাষ শেষ হলে ৫ ফুট প্রশস্ত বেড তৈরি করতে হবে। বেড তৈরির ৭ থেকে ১০ দিন পর কন্দ রোপণ করা উচিত। ০.৬ থেকে ১.১৮ ইঞ্চি ব্যাসের কন্দ লাগাতে হবে। সারি থেকে সারির দূরত্ব ১২ ইঞ্চি এবং কন্দ হতে কন্দের দূরত্ব ৮ ইঞ্চি। কন্দকে ৬ ইঞ্চি গভীরে লাগাতে হবে। কন্দ রোপণের আগে কন্দের সুপ্তাবস্থা (যে সময়টুকুতে বীজ গজাবে না তাকেই সুপ্তাবস্থা বলে) কাটানোর জন্য কন্দ গুলোকে ৪ শতাংশ থায়ো ইউরিয়া জলীয় দ্রবনে প্রায় ৩০ মিনিট চুবিয়ে রাখতে হবে।
চাষের সময়ে পরিচর্যা:
সেচ ও পানি নিষ্কাশন:
রজনীগন্ধার জমির মাটিতে সবসময় রস থাকা উচিত।
গ্রীষ্মকালে ৭ দিন পরপর এবং শীতকালে ১০ দিন পরপর সেচ দেওয়া উচিত।
আগাছা দমন:
রজনীগন্ধার জমি সবসময় আগাছা মুক্ত রাখতে হবে।
আগাছা দমনের সময় খেয়াল রাখতে হবে যেন কন্দের কোন ক্ষতি না হয়।
আগাছা দমনে প্রয়োজনে অনুমোদিত আগাছানাশক ১.৮ কেজি/একর প্রতি স্প্রে করতে হবে।
রোগবালাই এবং দমন পদ্ধতি:
ধ্বসা রোগ:
এ রোগের ফলে গাছের শিঁকড়ে পচন ধরে। শেষে গাছের পাতা খসে যায় এবং ফুলের মঞ্জরীগুলো মাটিতে ঢলে পড়ে।
ব্যবস্থাপনা:
আক্রান্ত গাছগুলো তুলে ধ্বংস করতে হবে।
গাছের গোড়ার মাটি প্রতি লিটার পানিতে ৪ গ্রাম কুপ্রাভিট/বেনডাজিম/ব্যাভিস্টিন/সেভিন মিশিয়ে সেই মিশ্রণ দিয়ে ভিজিয়ে দিতে হবে।
রোগাক্রান্ত গাছে ১৫ দিন পরপর ২ থেকে ৩ বার প্রতি লিটার পানিতে ৪ গ্রাম হারে কুপ্রাভিট/বেনডাজিম/ব্যাভিস্টিন/সেভিন মিশিয়ে প্রয়োগ করতে হবে।
অবশ্য বিশেষ ঞ র পরামর্শ নিন।
ব্যবস্থাপনা:
একই জমিতে পরপর দু’তিন বছর এক নাগাড়ে রজনীগন্ধা ও বেগুন জাতীয় ফসর চাষ না করা ভাল।
দু’সারি রজনীগন্ধা গাছের মধ্যে এক সারি গাঁদা গাছ লাগিয়ে গাঁদা-রজনীগন্ধার মিশ্র চাষ করলে শিকড়ে গিঁট কৃমির উপদ্রব কম হয়। জমিতে নিম খৈল ছিটানো যেতে পারে।
কন্দ রোপণের সময় সারির মাটিতে নিম খৈল ও নিউফরান ছিটিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে।
তারপর সেখানে কন্দ রোপণ করলে এ রোগের আক্রমণ অনেক কম হয়।
প্রাথমিকভাবে অল্প গাছ আক্রান্ত হলে সেসব গাছ তুলে জমি থেকে দূরে ফেলতে হবে বা পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
আক্রান্ত স্থানের মাটি কিছুটা গর্ত করে খড় জ্বালিয়ে মাটি পুড়াতে হবে।
পাতার দাগ রোগ:
এ রোগের ফলে রজনীগন্ধার গাছের পাতার অগ্রভাগ থেকে প্রথমে দাগ পড়ে।
পরে তা শুকিয়ে বাদামী হয়ে যায় ও ধীরে ধীরে নীচের দিকে পাতার কিনারা বরাবর ঢেউ খেলানো দাগের মত নামতে থাকে।
গাছ দুর্বল হয়ে শেষে মরে যায়।
ব্যবস্থাপনা:
একই জমিতে পরপর এক নাগাড়ে রজনীগন্ধা চাষ না করা ভাল।
প্রাথমিকভাবে অল্প গাছ আক্রান্ত হলে সেসব গাছের আক্রান্ত অংশ কেটে পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
জমি তৈরির সময় একর প্রতি ৬ থেকে ৯ কেজি হারে রুটোন/এগ্রো-গ্রো (দানাদার) প্রয়োগ করলে শিকড়ের রোগ বালাই কম হয়।
ফুল কাটা:
কন্দ লাগানোর ৭০ থেকে ৯০ দিনের মধ্যে গাছে স্টিক আসতে শুরু করে।
স্টিক কাটার সময় ধারালো ছুরি ব্যবহার করতে হবে।
রজনীগন্ধার স্টিকের প্রথম ফুল ফুটলেই ডাঁটিসহ ফুল কাটতে হবে।
ভোরের ঠান্ডা আবহাওয়ায় অথবা পড়ন্ত বিকেলে ফুল কাটতে হবে।
স্টিক কাটার সময় খেয়াল রাখতে হবে যেন এটি মাটি থেকে ১.৫ থেকে ২.৫ ইঞ্চি উপরে থাকে।
কাটার সাথে সাথে স্টিক গুলির নীচের কাটা অংশ পানিতে চুবিয়ে ছায়ায় রাখতে হবে , যেন ফুল ও স্টিকের সতেজভাব বজায় থাকে।
ফুল উৎপাদন
একর প্রতি রজনীগন্ধার স্টিক উৎপাদনের পরিমাণ প্রায় ১৫০০০০ থেকে ২০০০০০টি।