কিভাবে বাঁচবে পোল্ট্রি শিল্প?

কিভাবে বাঁচবে পোল্ট্রি শিল্প?

বর্তমান প্রেক্ষাপটে দৃশ্যত অভিভাবকহীন পোল্ট্রি শিল্পকে নিয়ে দু’একটি কথা না লিখলে নিজের কাছে নিজেকে অপরাধী মনে হয়। তাই নিতান্তই বিবেকের তাড়নায় দু’একটা কথা লিখছি।

বর্তমানে অন্তত ৬ মিলিয়ন (৬০ লাখ) মানুষ পোল্ট্রি শিল্পে কর্মরত আছে, ফলশ্রুতিতে এ শিল্পের উপর নির্ভর করে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জীবিকানির্বাহ করছে ১ কোটিরও বেশি মানুষ। তাই পোল্ট্রি শিল্প আমিষের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে আছে।
বলাযায়, পোল্ট্রি শিল্প বন্ধ হয়ে গেলে বাংলাকে একটি অপ্রত্যাশিত করুন পরিণতির মোকাবিলা করতে হবে। বর্তমানে যে বেহাল দশা চলছে তা আপন গতিতে চলতে থাকলে খুব শিঘ্রই অপ্রত্যাশিত সে অবস্থার সম্মুখীন হতে হবে আমার আপনার তথা গোটা দেশের। সময় এসেছে বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে এবং অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিবেচনা করে এ শিল্পকে যে কোন মূল্যে রক্ষা করার।

পোল্ট্রি শিল্প বাঁচাতে কিছু প্রস্তাব
ড. কেএইচএম নাজমুল হুসাইন নাজির
আপডেট: ১৪৪৩ ঘণ্টা, আগস্ট ২২, ২০১১

পোল্ট্রি শিল্প বাঁচাতে কিছু প্রস্তাব:বর্তমান প্রেক্ষাপটে দৃশ্যত অভিভাবকহীন বাংলাদেশের পোল্ট্রি শিল্পকে নিয়ে দু’একটি কথা না লিখলে নিজের কাছে নিজেকে অপরাধী মনে হয়। তাই নিতান্তই বিবেকের তাড়নায় দু’একটা কথা লিখছি।

প্রথমেই জেনে নেওয়া যাক বাংলাদেশের পোল্ট্রি শিল্পের বর্তমান হালচাল।
সন্দেহাতীতভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ এ শিল্প এখন এক নির্মম ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে।

বাংলাদেশে কমপক্ষে ১৫০ মিলিয়ন পোল্ট্রি ভোক্তা রয়েছে। পোল্ট্রি সেক্টরে বিনিয়োগ আছে ১৫ হাজার কোটি টাকার বেশি।
বর্তমানে অন্তত ৬ মিলিয়ন (৬০ লাখ) মানুষ পোল্ট্রি শিল্পে কর্মরত আছে, ফলশ্রুতিতে এ শিল্পের উপর নির্ভর করে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জীবিকানির্বাহ করছে ১ কোটিরও বেশি মানুষ। তাই পোল্ট্রি শিল্প বাংলাদেশে আমিষের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে আছে।
বলা যায়, পোল্ট্রি শিল্প বন্ধ হয়ে গেলে বাংলাদেশকে একটি অপ্রত্যাশিত করুন পরিণতির মোকাবিলা করতে হবে। বর্তমানে যে বেহাল দশা চলছে তা আপন গতিতে চলতে থাকলে খুব শিঘ্রই অপ্রত্যাশিত সে অবস্থার সম্মুখীন হতে হবে আমার আপনার তথা গোটা দেশের। সময় এসেছে বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে এবং অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিবেচনা করে এ শিল্পকে যে কোন মূল্যে রক্ষা করার।

বিগত ২০০৭-০৮ এর আগে বাংলাদেশে প্রায় দেড় লাখ পোল্ট্রি খামার ছিলো। গত দুই দশকে পোল্ট্রি শিল্পের প্রবৃদ্ধি ছিলো বছরে ২০% এর আশেপাশে। ২০০৭-০৮ সালে ব্যাপক আকারে বাংলাদেশে বার্ড ফ্লু দেখা দেয়, যার কারণে খামারিরা আর্থিকভাবে মারাত্বক ক্ষতিগ্রস্ত হয়, লোকসান হয় প্রায় ৭১৪ মিলিয়ন ইউএস ডলার (প্রায় ৫ হাজার ৩শ’ কোটি টাকা)। লোকসানের ধাক্কা সহ্য করতে না পেরে একে একে অনেক খামারি তাদের খামার গুটিয়ে ফেলতে বাধ্য হয়। সারাদেশে বর্তমানে মাত্র ৭৫ হাজার থেকে ৮০ হাজার পোল্ট্রি খামার রয়েছে। অথচ গত বছর জুন মাসেও ছিলো ১ লাখ ১৪ হাজার এবং ডিসেম্বরে ৯৮ হাজার।

চলতি বছরের শুরুর দিকে দেশের পোল্ট্রি শিল্পে আবার বার্ড ফ্লু আক্রমণ করায় ৭০০ কোটি টাকা ক্ষতি হয় (ব্রিডারর্স এসোসিয়েশনের তথ্যানুযায়ী)। এতে বন্ধ হয়ে যায় শত শত খামার, কর্ম হারায় অগনিত কর্মরত কর্মচারী। এহেন দারুণ নাজুক পরিস্থিতির সঙ্গে নতুন মাত্রা হিসেবে যোগ হয়েছে পোল্ট্রি খাবার, ঔষধ ও একদিনের বাচ্চার অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি। পক্ষান্তরে পোল্ট্রি ও ডিম উৎপাদনের খরচের তুলনায় কম মূল্য পাওয়ার কারণে অসহা খামারিদের শেষ সম্বলটুকু হারিয়ে পথে বসার মত অবস্থা। প্রতিনিয়ত যে অবস্থার নির্মম শিকার হয়েছে বা হচ্ছে অগনিত খামারি।

একটি গবেষণায় দেখা গেছে পোল্ট্রি উৎপাদনে মোট খরচের শতকরা ৬৫ থেকে ৭৫ ভাগ খরচ হয় শুধুমাত্র খাবারের পেছনে। সুতরাং খাবারের মূল্য কমানো বা নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং এর সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়গুলোকে সহজতর করা প্রয়োজন। পত্রপত্রিকা ও ডিজিটাল মিডিয়ার বদৌলতে জানা গেছে, গত ছয় মাসে পোল্ট্রি খাবারের দাম শতকরা ৩০ ভাগ বাড়ায় প্রতিটি ডিমে ১ দশমিক ৫০ টাকা ও প্রতিকেজি ব্রয়লারে ২৫ টাকা লোকসান গুনতে হয়েছে খামারিদের। অবশ্য পোল্ট্রি খাবারে কত ভাগ দাম বাড়লো আর কত টাকা লোকসান হলো সেটা সাধারণ ভোক্তাদের জানার বা বিবেচনারও বিষয় নয়। তাদের কাছে কম মূল্যে মুরগি ও ডিম খেতে পারাই বড় কথা। তবে পোল্ট্রি সেক্টরের পুরো সিস্টেমে যে খারাপ প্রভাব পড়েছে তা সহজেই সবার গোচরে এসেছে।

একদিকে হ্যাচারি মালিকেরা লোকসান গুনছে কেননা তাদের বাচ্চা বিক্রি হচ্ছে না।
অন্যদিকে খামারিরা বাচ্চা কিনে তা পালন করার সাহস পাচ্ছে না। পরিনামে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে একের পর এক মুরগি খামার। ক্রমাম্বয়ে পোল্ট্রি খামার সংখ্যা এভাবে কমতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে কি ঘটবে তা সহজেই অনুমেয়। একদিকে দেশের মানুষ আরো বেশি অপুষ্টিতে (বিশেষ করে আমিষের অভাবে) ভুগবে, অন্যদিকে লাখ লাখ মানুষ বেকার হয়ে সমাজের বোঝা হয়ে পড়বে। সেই সঙ্গে বৃদ্ধি পাবে অপকর্ম-সন্ত্রাস-ছিনতাই-রাহাজানি ইত্যাদি। নষ্ট হবে সমাজের ভারসাম্য, যা কোন অবস্থাতেই কাম্য নয়।
তথ্যানুযায়ী, একজন মানুষকে বছরে ৫৮ কেজি মাংস এবং ৩৬৫টি ডিম খাওয়া দরকার। যেখানে বাংলার মানুষের বছরে মাংস খাওয়া পড়ে মাত্র ১১ দশমিক ২৭ কেজি (হিসাবটি পোল্ট্রি এবং অন্য উৎস একত্রে), আর ডিম মাত্র ৩০টি। আর ইউরোপিয় ইউনিয়ন এবং যুক্তরাষ্ট্রে মাথাপিছু বছরে ২৩০টি ডিম খাওয়া হয়।
শিল্প ও বাড়তি মানুষের আবাসনের চাহিদা মেটাতে প্রতি বছর ১% হারে আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ কমছে। বিষয়টা ইতিমধ্যে সরকারের গোচরীভুত হয়েছে এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে যদিও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে তেমন অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না। সুতরাং আমাদের মোট জমির সীমাবদ্ধতা, আর্থ-সামাজিক অবস্থা, পরিবেশের উপর প্রভাব ও সময়ের চাহিদার উপর ভিত্তি করে বিকাশমান কিছু শিল্পের উপর গুরুত্ব দেওয়া এখন সময়ের দাবি। বিভিন্ন দিক বিবেচনায় পোল্ট্রি বাংলাদেশের জন্য মানানসই এবং উপযোগী একটি শিল্প। কেননা পোল্ট্রি বাংলার জন্য এখনো একটি সস্তা কিন্তু উন্নত আমিষের উৎস। পোল্ট্রি উৎপাদন করতে প্রয়োজন হয় মাছ র তুলনায় কম জায়গা ও সময়, পোল্ট্রি খামার শুরু করতে অপেক্ষাকৃত কম পুঁজি প্রয়োজন হয় যা স্বল্প আয়ের মানুষের পক্ষেও অল্প পুঁজিতে শুরু করা সম্ভব। মাল্টি লেয়ার (ফ্লোর) খামারের মাধ্যমে অল্প জায়গায় স্বল্প সময়ের মধ্যে অনেক বেশি উৎপাদন।
পোল্ট্রি নিয়ে গবেষণায় আমরা পিছিয়ে থাকলেও, সারা বিশ্বে চলছে বিস্তর গবেষণা। আমেরিকাতে ১৯২৫ সালে যেখানে পোল্ট্রির ২ পাউন্ড ওজন হতে সময় লাগতো ১১২ দিন, একবিংশ শতাব্দীতে জিনগত, চিকিৎসা ও ব্যবস্থাপনার উন্নয়নের মাধ্যমে এখন ৭ পাউন্ড ওজন হতে সময় লাগে মাত্র ৪০ দিন।
1:নাম জাতীয় আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিনোদন খেলা স্বাস্থ্য তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষা চট্টগ্রাম প্রতিদিন
search
পোল্ট্রি শিল্প বাঁচাতে কিছু প্রস্তাব
ড. কেএইচএম নাজমুল হুসাইন নাজির

আপডেট: ১৪৪৩ ঘণ্টা, আগস্ট ২২, ২০১১

পোল্ট্রি শিল্প বাঁচাতে কিছু প্রস্তাব

বর্তমান প্রেক্ষাপটে দৃশ্যত অভিভাবকহীন বাংলাদেশের পোল্ট্রি শিল্পকে নিয়ে দু’একটি কথা না লিখলে নিজের কাছে নিজেকে অপরাধী মনে হয়। তাই নিতান্তই বিবেকের তাড়নায় দু’একটা কথা লিখছি।

প্রথমেই জেনে নেওয়া যাক বাংলাদেশের পোল্ট্রি শিল্পের বর্তমান হালচাল।
সন্দেহাতীতভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ এ শিল্প এখন এক নির্মম ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে।

বাংলাদেশে কমপক্ষে ১৫০ মিলিয়ন পোল্ট্রি ভোক্তা রয়েছে। পোল্ট্রি সেক্টরে বিনিয়োগ আছে ১৫ হাজার কোটি টাকার বেশি।
বর্তমানে অন্তত ৬ মিলিয়ন (৬০ লাখ) মানুষ পোল্ট্রি শিল্পে কর্মরত আছে, ফলশ্রুতিতে এ শিল্পের উপর নির্ভর করে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জীবিকানির্বাহ করছে ১ কোটিরও বেশি মানুষ। তাই পোল্ট্রি শিল্প বাংলাদেশে আমিষের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে আছে।

বলা যায়, পোল্ট্রি শিল্প বন্ধ হয়ে গেলে বাংলাদেশকে একটি অপ্রত্যাশিত করুন পরিণতির মোকাবিলা করতে হবে। বর্তমানে যে বেহাল দশা চলছে তা আপন গতিতে চলতে থাকলে খুব শিঘ্রই অপ্রত্যাশিত সে অবস্থার সম্মুখীন হতে হবে আমার আপনার তথা গোটা দেশের। সময় এসেছে বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে এবং অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিবেচনা করে এ শিল্পকে যে কোন মূল্যে রক্ষা করার।

বিগত ২০০৭-০৮ এর আগে বাংলাদেশে প্রায় দেড় লাখ পোল্ট্রি খামার ছিলো। গত দুই দশকে পোল্ট্রি শিল্পের প্রবৃদ্ধি ছিলো বছরে ২০% এর আশেপাশে। ২০০৭-০৮ সালে ব্যাপক আকারে বাংলাদেশে বার্ড ফ্লু দেখা দেয়, যার কারণে খামারিরা আর্থিকভাবে মারাত্বক ক্ষতিগ্রস্ত হয়, লোকসান হয় প্রায় ৭১৪ মিলিয়ন ইউএস ডলার (প্রায় ৫ হাজার ৩শ’ কোটি টাকা)। লোকসানের ধাক্কা সহ্য করতে না পেরে একে একে অনেক খামারি তাদের খামার গুটিয়ে ফেলতে বাধ্য হয়। সারাদেশে বর্তমানে মাত্র ৭৫ হাজার থেকে ৮০ হাজার পোল্ট্রি খামার রয়েছে। অথচ গত বছর জুন মাসেও ছিলো ১ লাখ ১৪ হাজার এবং ডিসেম্বরে ৯৮ হাজার।

চলতি বছরের শুরুর দিকে দেশের পোল্ট্রি শিল্পে আবার বার্ড ফ্লু আক্রমণ করায় ৭০০ কোটি টাকা ক্ষতি হয় (ব্রিডারর্স এসোসিয়েশনের তথ্যানুযায়ী)। এতে বন্ধ হয়ে যায় শত শত খামার, কর্ম হারায় অগনিত কর্মরত কর্মচারী। এহেন দারুণ নাজুক পরিস্থিতির সঙ্গে নতুন মাত্রা হিসেবে যোগ হয়েছে পোল্ট্রি খাবার, ঔষধ ও একদিনের বাচ্চার অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি। পক্ষান্তরে পোল্ট্রি ও ডিম উৎপাদনের খরচের তুলনায় কম মূল্য পাওয়ার কারণে অসহা খামারিদের শেষ সম্বলটুকু হারিয়ে পথে বসার মত অবস্থা। প্রতিনিয়ত যে অবস্থার নির্মম শিকার হয়েছে বা হচ্ছে অগনিত খামারি।

একটি গবেষণায় দেখা গেছে পোল্ট্রি উৎপাদনে মোট খরচের শতকরা ৬৫ থেকে ৭৫ ভাগ খরচ হয় শুধুমাত্র খাবারের পেছনে। সুতরাং খাবারের মূল্য কমানো বা নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং এর সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়গুলোকে সহজতর করা প্রয়োজন। পত্রপত্রিকা ও ডিজিটাল মিডিয়ার বদৌলতে জানা গেছে, গত ছয় মাসে পোল্ট্রি খাবারের দাম শতকরা ৩০ ভাগ বাড়ায় প্রতিটি ডিমে ১ দশমিক ৫০ টাকা ও প্রতিকেজি ব্রয়লারে ২৫ টাকা লোকসান গুনতে হয়েছে খামারিদের। অবশ্য পোল্ট্রি খাবারে কত ভাগ দাম বাড়লো আর কত টাকা লোকসান হলো সেটা সাধারণ ভোক্তাদের জানার বা বিবেচনারও বিষয় নয়। তাদের কাছে কম মূল্যে মুরগি ও ডিম খেতে পারাই বড় কথা। তবে পোল্ট্রি সেক্টরের পুরো সিস্টেমে যে খারাপ প্রভাব পড়েছে তা সহজেই সবার গোচরে এসেছে।

একদিকে হ্যাচারি মালিকেরা লোকসান গুনছে কেননা তাদের বাচ্চা বিক্রি হচ্ছে না, অন্যদিকে খামারিরা বাচ্চা কিনে তা পালন করার সাহস পাচ্ছে না। পরিনামে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে একের পর এক মুরগি খামার। ক্রমাম্বয়ে পোল্ট্রি খামার সংখ্যা এভাবে কমতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে কি ঘটবে তা সহজেই অনুমেয়। একদিকে দেশের মানুষ আরো বেশি অপুষ্টিতে (বিশেষ করে আমিষের অভাবে) ভুগবে, অন্যদিকে লাখ লাখ মানুষ বেকার হয়ে সমাজের বোঝা হয়ে পড়বে। সেই সঙ্গে বৃদ্ধি পাবে অপকর্ম-সন্ত্রাস-ছিনতাই-রাহাজানি ইত্যাদি। নষ্ট হবে সমাজের ভারসাম্য, যা কোন অবস্থাতেই কাম্য নয়।

ন্যাশনাল পোল্ট্রি ইন্ড্রাস্ট্রিজ প্রোটেকশন কাউন্সিলের সূত্র মতে, গত বছরের জুনে বাংলাদেশে প্রতিদিন পোল্ট্রি উৎপাদন হয়েছিল ১ দশমিক ৯৫ মিলিয়ন কেজি, যা ডিসেম্বরে কমে নেমে আসে ১ দশমিক ৭০ মিলিয়ন কেজিতে। চলতি বছরের মার্চে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ১ দশমিক ৬০ মিলিয়ন কেজিতে। অন্যদিকে ডিম উৎপাদন গত বছর জুনে ছিল ২৭ দশমিক ৫ মিলিয়ন (প্রতিদিন), যা ডিসেম্বরে ২৬ মিলিয়ন ও চলতি বছর মার্চে ২৩ দশমিক ৫ মিলিয়নে নেমেছে। গত নয় মাসে বাংলাদেশে পোল্ট্রি উৎপাদন গড়ে ১৮% কমেছে যা রীতিমত উদ্বেগের বিষয়।

ফুড এন্ড এগ্রিকালচার অরগানাইজেশনের (ফাও) তথ্যানুযায়ী, একজন মানুষকে বছরে ৫৮ কেজি মাংস এবং ৩৬৫টি ডিম খাওয়া দরকার। যেখানে বাংলাদেশের মানুষের বছরে মাংস খাওয়া পড়ে মাত্র ১১ দশমিক ২৭ কেজি (হিসাবটি পোল্ট্রি এবং অন্য উৎস একত্রে), আর ডিম মাত্র ৩০টি। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে একজন মানুষ বছরে ৪৭টি ডিম খেয়ে থাকে, আর ইউরোপিয় ইউনিয়ন এবং যুক্তরাষ্ট্রে মাথাপিছু বছরে ২৩০টি ডিম খাওয়া হয়।

বাংলাদেশ বিশ্বের মধ্যে অন্যতম একটি ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। বাংলাদেশে প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ১,২৬৩ জন মানুষ বাস করে (২০১১ সালের বিশ্ব ব্যাংকের হিসেব অনুযায়ী)। যেখানে মঙ্গোলিয়াতে বাস করে ২ জনেরও কম মানুষ। অত্যন্ত ঘন বসতিপূর্ণ বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান শিল্প ও বাড়তি মানুষের আবাসনের চাহিদা মেটাতে প্রতি বছর ১% হারে আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ কমছে। বিষয়টা ইতিমধ্যে সরকারের গোচরীভুত হয়েছে এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে যদিও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে তেমন অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না। সুতরাং আমাদের মোট জমির সীমাবদ্ধতা, আর্থ-সামাজিক অবস্থা, পরিবেশের উপর প্রভাব ও সময়ের চাহিদার উপর ভিত্তি করে বিকাশমান কিছু শিল্পের উপর গুরুত্ব দেওয়া এখন সময়ের দাবি। বিভিন্ন দিক বিবেচনায় পোল্ট্রি বাংলাদেশের জন্য মানানসই এবং উপযোগী একটি শিল্প। কেননা পোল্ট্রি বাংলাদেশের জন্য এখনো একটি সস্তা কিন্তু উন্নত আমিষের উৎস। পোল্ট্রি উৎপাদন করতে প্রয়োজন হয় মাছ বা গরুর তুলনায় কম জায়গা ও সময়, পোল্ট্রি খামার শুরু করতে অপেক্ষাকৃত কম পুঁজি প্রয়োজন হয় যা স্বল্প আয়ের মানুষের পক্ষেও অল্প পুঁজিতে শুরু করা সম্ভব। মাল্টি লেয়ার (ফ্লোর) খামারের মাধ্যমে অল্প জায়গায় স্বল্প সময়ের মধ্যে অনেক বেশি উৎপাদন করা যায় যা গরু বা মাছ চাষের ক্ষেত্রে সম্ভব নয়।

আমেরিকাতে একটি গবেষণায় দেখা গেছে, এক পাউন্ড গরুর মাংস উৎপাদন করতে প্রয়োজন হয় ৪ পাউন্ড দানাদার খাবার এবং ৪ হাজার গ্যালন পানি। অন্যদিকে, এক পাউন্ড পোল্ট্রি উৎপাদনে প্রয়োজন হয় মাত্র ২ পাউন্ড দানাদার খাবার এবং মাত্র ৭৫০ গ্যালন পানি। এদিক দিয়ে গরুর তুলনায় পোল্ট্রি উৎপাদন একদিকে যেমন খরচ বাঁচায় অন্যদিকে পৃথিবীর জন্য হয় পরিবেশ বান্ধব।

পোল্ট্রি নিয়ে গবেষণায় আমরা পিছিয়ে থাকলেও, সারা বিশ্বে চলছে বিস্তর গবেষণা। আমেরিকাতে ১৯২৫ সালে যেখানে পোল্ট্রির ২ পাউন্ড ওজন হতে সময় লাগতো ১১২ দিন, একবিংশ শতাব্দীতে জিনগত, চিকিৎসা ও ব্যবস্থাপনার উন্নয়নের মাধ্যমে এখন ৭ পাউন্ড ওজন হতে সময় লাগে মাত্র ৪০ দিন।

বাংলাদেশের পোল্ট্রি শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে কিছু প্রস্তাবনা নিচে দেওয়া হলো-

১. মানসম্পন্ন নিরবিচ্ছিন্ন গবেষণা: দেশ ও দেশের মানুষের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কোন শিল্পকে স্থায়ী রূপ দিতে প্রয়োজন তার উপর নিরবিচ্ছিন্ন মানসম্পন্ন গবেষণা। বাংলাদেশের পোল্ট্রি সেক্টরকে ঘিরে মানসম্পন্ন Qualitative এবং Quantitative গবেষণার কোন বিকল্প নেই। ছড়িয়ে ছিটিয়ে কেবল রোগের প্রাদুর্ভব দেখা দিলে একটু আধটু গবেষণার মাধ্যমে বাংলার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এ শিল্প রক্ষা পাবে বলে আমার মনে হয় না। গবেষণার মাধ্যমে কম মূল্যে দেশীয় কাঁচামাল দ্বারা উন্নত পোল্ট্রি খাবার প্রস্তুত করার কৌশল, দেশের উপযোগী কার্যকরী টিকা উদ্ভাবন ও উৎপাদন, দেশের আবহাওয়ার সঙ্গে মানানসই মুরগি-স্ট্রেইন উদ্ভাবন ইত্যাদি বিষয়কে মাথায় রেখে গবেষণা কাজে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় আর্থিক সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। পোল্ট্রি বিষয়ক গবেষণা কাজের জন্য অর্থ খরচ করার উৎকৃষ্ট জায়গা হচ্ছে দেশের ভেটেরিনারি ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য গবেষণা প্রতিষ্টানসমূহ। গবেষণা (বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা) ছাড়া কোন দেশ উন্নত হয়েছে এমন নজির আমার জানা নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাকল্পে অকৃপণ হস্তে অর্থ সরবরাহ করলে একদিকে যেমন উন্নত গবেষণার মাধ্যমে প্রয়োজনীয় সমাধান বের হয়ে আসবে অন্যদিকে ছাত্রছাত্রীরা গবেষণা কাজের সঙ্গে একাত্বভাবে মিশে থাকবে। এতে তারা কর্মক্ষেত্রে অনেক বেশি অভিজ্ঞ হিসেবে ঢুকতে পারবে যা দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে জরুরি।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

হোম
জয়েন গ্রুপ
স্থানীয় খবর
জয়েন গ্রুপ
গুগল নিউজ