কম খরচে বাড়ির পুকুরে অধিক মাছের ফলন কিভাবে করবেন জানুন

কম খরচে বাড়ির পুকুরে অধিক মাছের ফলন কিভাবে করবেন জানুন

বাড়ির পুকুরে চাষের ক্ষেত্রে আমরা অনেকেই সেই ভাবে লক্ষ নজর করে উঠতে পারি না। দেখা গেছে, গৃহস্থের পুকুর মালিকরা অধিকাংশই অন্য কোনও পেশার সাথে যুক্ত থাকেন। কেউ স্কুলের শিক্ষক, কেউ চাকরিজীবী, কেউবা দোকান করেন বা অন্য কোনও ব্যবসা। খুব কম সংখকই আছেন যাঁরা বাড়ির পুকুরে খুব নজর দিয়ে চাষ করে থাকনে। আসলে চাষের জন্য সময় থাকে না ও সঠিক পদ্ধতি না জানার ফলে মাছ চাষের বিভিন্ন সমস্যায় পড়েন। তখন এদিক ওদিক কিছু পরামর্শ নিয়ে বাজার চলতি অনেক রকম পদার্থ বা উপকরণ প্রয়োগ করে ফেলেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ওই উপাদানের সঠিক পরিমাণ ও কার্যকারীতা সম্পর্কে সম্যক ধারণা না থাকার ফলে পুকুরে মাছের হিতে বিপরীত হয়। তাই, এই সব বাড়ির পুকুরের মালিকরা যদি ব্লক অফিসে মৎস্য দপ্তরের মৎস্যচাষ সম্প্রসারণ আধিকারিকের সাথে দেখা করে সঠিক পরামর্শ নিয়ে চাষ করেন তবে মাছের সঠিক উৎপাদন পেতে পারেন।

আমরা পুকুর কে বলি “মিনি ব্যাংক”। কারণ, হঠাৎ যদি আপনার টাকার প্রয়োজন হয় তবে এক খেপলা জাল ফেলে মাছ ধরলেই টাকা। অনেক সময়েই বাজার পর্যন্ত যেতে হয় না। পুকুর পাড়েই মাছ বিক্রি হয়ে যায়। তাই এত দ্রুত ও সহজে টাকা রোজগারের এই পন্থার জন্য পুকুরের যত্ন নিতেই হবে।

অনেক সময় অনেকে ভাবেন বিজ্ঞানসম্মত উপায় মাছ চাষ মানেই অনেক খরচ। কিন্তু বিষয়টা পুরো উলটো। বিজ্ঞান সম্মত উপায় মাছ চাষ বলতে সম্যক ধারণা রেখে মাছ চাষ। অর্থাৎ মাছ চাষের জন্য আপনি যে যে উপকরণ বা উপাদান অর্থাৎ মাছ, সার, খাবার ইত্যাদি প্রয়োগ করছেন সেই গুলো কতটা পরিমান দেবেন, কখন দেবেন, কিভাবে দেবেন সর্বোপরি কেন দেবেন, এই সব বিষয়ে আগে নিজেকে জানতে হবে। আর জেনে বুঝে হিসেব রেখে চাষ করাকেই বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে মাছ চাষ বলে।

প্রথমত যেটা করতে হবে, একেবারে চাষের শুরুতেই বছরে মে-জুন মাসের দিকে হিসেব করেই মাছ ছাড়ুন। প্রতি ডেসিম্যাল পুকুরে ৩০-৪০টি মাছ ছাড়তে হবে। এবং মাছের সাইজ হতে হবে বড়। বাড়ির পুকুরে বড় সাইজের চারাপোনা ছেড়ে চাষ করাই লাভজনক। কারণ, এতে মাছের মৃত্যু হার অনেক কম হয় এবং মাছের বৃদ্ধিও দ্রুত আসে। এবং সব রকমের পাঁচ মেশালি মাছ ছাড়াই বুদ্ধিমানের কাজ। শুধু খেয়াল রাখতে হবে, গাছ লাগালাম আবার পাশে ছাগল ছেড়ে দিলাম এমন যেন না হয়। তবে রাক্ষুসে জাতীয় মাছ ছাড়া অন্যান্য সব ধরনের মাছ খাদ্য খাদক সম্পর্ক মাথায় রেখে মাছ ছাড়তে হবে। এক ডেসিম্যাল একটা পুকুরে হিসেব করলে ১৫০-২০০ গ্রাম ওজনের ২টি, ২৫০-৩০০ গ্রাম ওজনের কাতলা ৪টি, ১০০-১৫০ গ্রাম ওজনের রুই মাছ ২০টি, এর সাথে ৫০-১০০ গ্রাম ওজনের মৃগেল ৬টি, ৫০-১০০ গ্রাম ওজনের গ্রাসকার্প ১টি। এরসাথে ২ গ্রাম ওজনের আমুর কার্প ৭০টি বা বাটা, পুঁটি প্রভৃতি মাছ সংখ্যা সামঞ্জস্য রেখে ছাড়া যেতে পারে।

তবে মাছ ছাড়ার আগে পুকুরটাকে ঠিক মতো তৈরি করে নিতে হবে। পুকুরে জুস প্রয়োগ অত্যন্ত কার্যকরী পদ্ধতি। এতে মাছের খাবার ও ঔষুধের খরচ অনেক কম হয়। এক হাজার বর্গ মিটার জলাশয়ের জন্য ৩ কেজি বাদাম খোল, ২.৫ কেজি চালের গুঁড়ো, ৩ কেজি চিটে গুঁড়, ৫০০ গ্রাম ঈষ্ট পাউডার একসাথে অধিক পরিমান জলে মিশিয়ে ঢাকনা যুক্ত পাত্রে তিন দিন পচিয়ে নিয়ে উপাদান গুলো পুকুরে প্রয়োগ করতে হবে। এর ফলে মাছের দারুন আশানুরুপ উৎপাদন পাওয়া যাবে। মাসে এক- দু বার করে প্রয়োগ করতে হবে। সপ্তাহে সপ্তাহে এক ডেসিম্যাল পুকুরের জন্য (গভীরতা ১ মিটার) ১ কেজি গোবর কমপক্ষে তিন দিন পচিয়ে তিন গুন জলে গুলে নিয়ে পুকুরে ছিটিয়ে দিতে হবে। এতে পুকুরে মাছের প্রাকৃতিক খাবার তৈরি হবে। উদ্ভিদকণা ও প্রাণীকণা হল মাছের প্রাকৃতিক খাবার। প্রাকৃতিক খাবার ঠিক মতো থাকলে মাছের বৃদ্ধি যেমন ভালো হবে তেমনই প্রাকৃতিক খাবার খাওয়ার ফলে মাছের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে এবং মাছটি সুস্বাদু ও স্বাস্থ্যকর হবে। এতে মাছের উৎপাদনও বৃদ্ধি পাবে। পুকুরে চুন প্রয়োগ করতে হবে। এমনিতে মাছের দেহের প্রয়োজনীয় ক্যালসিয়াম জোগাতে চুন খুবই উপকারি। তাছাড়া চুন প্রয়োগে জলের অম্লত্ব ও ক্ষারত্ব ঠিক ঠাক থাকে। পুকুরে চুন দিলে বিভিন্ন রোগের জীবাণু ও পরজীবি ধ্বংস করে। পুকুরের বিষাক্ত গ্যাস দূর হয়। পুকুরে উদ্ভিদকণা  জন্মাতে ও জলে অক্সিজেনের পরিমান ঠিক রাখতে চুন বিশেষ ভাবে ভূমিকা পালন করে। তাই মাসে দুবার পনেরো দিন অন্তর ডেসিম্যাল পিছু ১৫০ গ্রাম চুন জলে গুলে পুকুরে ছিটিয়ে দিতে হবে। মাসে একবার জাল টানতেই হবে। টানা জালে মাছ গুলোকে এক জায়গায় নিয়ে এসে ডেসিম্যাল প্রতি ২০০ গ্রাম নুন ও ৫ গ্রাম পটাশিয়াম পার ম্যাঙ্গানেট দিয়ে মাছ গুলো ভালো করে ধুয়ে আবার পুকুরে ছাড়তে হবে। এতে মাছের শরীরে কোনও রকম রোগ দেখা যাবে না। মাছ স্বাস্থ্যকর হবে। এর সাথে মাছ চাষ ও বিপণনের আয়-ব্যয়ের হিসাব বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কারণ সঠিক হিসাব না রাখলে লাভ-লোকসানের সঠিক হিসাবও পাওয়া যায় না। প্রতিদিনের আয়-ব্যয় ও উৎপাদন বিবরণী স্বতন্ত্র রেজিস্টারে লিপিবদ্ধ করতে হয় ও এসব পর্যালোচনা করলে পরবর্তী বছর আরও লাভজনকভাবে পুকুর পরিচালনা করা সম্ভব হবে।

সুতরাং বাড়ির পুকুরে মাছ চাষের জন্য মিশ্রপদ্ধতিতে নির্দিষ্ট সংখ্যায় মাছ ছাড়তে হবে। মাসে মাসে চুন, জৈব জুস ও জাল টেনে নুন এবং পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেটে মাছ গুলো ধুয়ে ছাড়লে বাড়ির পুকুরেই অধিক মাছের উৎপাদন পাওয়া সম্ভব, এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায়। তবে এর সাথে অধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, এই সব পুকুর মালিকদের মৎস্য আধিকারিক বা মৎস্য বিশেষজ্ঞদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে হবে। পুকুর অনুযায়ী কি মাছ চাষ করলে আরও ভাল হবে সেটা তিনি জানিয়ে দেবেন। তাই পুকুরের জল মাটির পরীক্ষা ও মৎস্য পরামর্শ নিলে বাড়ির পুকুরে মাছ চাষ করে লাভবান হবেনই হবেন। একশ শতাংশ নিশ্চিত ভাবে বলা যায়। আর এই কথাটি মাথায় রাখবেন সর্বাপেক্ষা সাশ্রয়ী অথচ সঠিক প্রযুক্তি ব্যবহার মাছচাষে সাফল্য লাভের অন্যতম পূর্বশর্ত।

মন্তব্য:চাষের আগে থেকেই বিশেষজ্ঞ এর সাথে কথা বলে নিশ্চিত করে নিন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

হোম
জয়েন গ্রুপ
স্থানীয় খবর
জয়েন গ্রুপ
গুগল নিউজ