বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক গাঁদা ফুলের চাষ

বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক গাঁদা ফুলের চাষ

বাংলা একটি কৃষি প্রধান। এদেশের চাষিরা ধান, পাট, আখ, গম ও বিভিন্ন প্রকার সবজি চাষাবাদ করে সারা বছর তাদের জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। কিন্তু এসবের বাইরে কিছু ফসল আছে যা চাষ করে চাষিরা ব্যাপক সফলতা অর্জন করতে পারে। ফুল তার মধ্যে অন্যতম সম্ভাবনাময় ।

এক সময় ফুলের উৎপাদন ছিল বাড়ির উঠোন কিংবা ছাদের কোণায় টবের মধ্যে সীমাদ্ধ। কিন্তু বর্তমানে সৌখিন উৎপদকের গন্ডী পেরিয়ে ফুলের ব্যাপক চাষাবাদ হচ্ছে। শুধু আবাদই নয় ফুল এখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানিও হচ্ছে। তাই যে কেউ-ই নিজেকে একজন আর্দশ ফুল চাষি হিসেবে গড়ে তুলে নিজের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারে। আমাদের চাষিরা আরও ব্যাপকভাবে ফুল চাষের দিকে এগিয়ে আসুক এবং আর্থিক ভাবে সফলতা অর্জন করবে এই আমাদের আশা। বর্তমানে ঋতু ভিত্তিক তিন জাতের গাঁদা ফুলের চাষ করা হয়। এগুলো হলো গরম, বর্ষা এবং শীত এই তিন জাতের। ফুলের চাষ এবং অন্যান্য ফসলের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায় ফুল চাষই অধিক লাভজনক।

গরম জাতের গাঁদা ফুলের চাষ

এই ফুল চাষ করতে হলে পর্যায়ক্রমে যে কাজগুলো করতে হয় তা এখানে আলোচনা করা হলো-

জমি নির্বাচন

ফুলের চাষ করতে হলে প্রথমেই জমি নির্বাচন করতে হবে। সাধারণত এঁটেল দো-আঁশ মাটি ফুল চাষের জন্য বেশি উপযোগী। যে জমিতে ফুল চাষ করা হবে, খেয়াল রাখতে হবে তা যেন নিচু না হয়। অর্থাৎ জমিতে যেন পানি জমে না থাকে। পাশাপাশি জমিতে সেচ দেয়ার ব্যবস্থা থাকতে হবে।

জমি চাষ

জমি নির্বাচন করার পর জমিতে ৩/৪টা চাষ দিয়ে মাটি তৈরি করতে হবে। মাটি যেন ঝুরঝুরে ও ছোট টুকরো হয়। শেষ চাষের আগে জমিতে গোবর সার দিতে পারলে ভাল হয়। মাটির নিচে প্রচুর কেঁচো থাকে যা গাছ কেটে নষ্ট করে দেয়। তাই শেষ চাষের আগে মাটিতে কেঁচোনাশক যে কোন ওষুধ দিতে হবে। তারপর মই দিয়ে মাটি সমান করে দিতে হবে।

চারা সংগ্রহ

অগ্রহায়ণ – পৌষ মাসে সাধারণত গরম জাতের ফুলের চারা লাগাতে হয়। এই জাতের ফুলের চারা সংগ্রহ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমাদের দেশের কিছু চাষি এই চারা উৎপাদন করে ঠিকই কিন্তু গুণগত মান ভালো হয় না। ভাল করে চারা তৈরি করা দরকার।

চারা রোপন

যে দিন চারা আসবে অর্থাৎ নিজের হাতে যে দিন চারা পৌঁছাবে সে দিনই জমিতে শেষ চাষ এবং কেঁচো মারার ওষুধ দিয়ে দুপুরের দিকে সেচ দিয়ে সমস্ত জমি ভেজাতে হবে। তারপর বিকালে যখন রোদের তাপ কমে যায় তখন চারা রোপণ করতে হবে। চারা রোপণ করার সময় রশি ধরে সারিবদ্ধভাবে রোপণ করতে হবে। চারা রোপণের জন্য সারি থেকে সারির দুরত্ব হবে দুই হাত এবং চারা থেকে চারার দুরত্ব হবে ৬ ইঞ্চি। গরম জাতের ফুলের চারা লাগানোর পরে অনেক চারা মারা যায় এবং অনেক গাছে পুরুষ ফুল হয় সেটা বাজারে চলে না। তাই ওই জাতীয় গাছগুলো তুলে ফেলতে হয়। এইজন্য অন্যজাতের চেয়ে গরম জাতের চারা একটু ঘন করে লাগাতে হয়।

পরিচর্যা

আমি মনে করি যে কোন সাফল্যের মূলেই রয়েছে সততা, সঠিক পরিকল্পনা এবং পরিশ্রম। যে কোন ফসল উৎপাদনের ক্ষেত্রে পরিচর্যাটাই হচ্ছে প্রধান। ফসলের সঠিক পরিচর্যা যদি আপনি না করেন, সঠিক ভাবে সার ও ওষুধ যদি আপনি না দেন তাহলে ফসল উৎপাদনের ক্ষেত্রেও আপনি সফলকাম হবেন না। এইজন্য ফুলের চারা লাগানোর পর তার সঠিক পরিচর্যাটাই হচ্ছে মূল কাজ। চারা লাগানোর পর ৮/১০ দিন কোন কিছু করতে হয় না। এর পর যদি জমি শুকিয়ে যায় অর্থাৎ যদি মনে হয় মাটিতে পর্যাপ্ত রস নেই তাহলে সেচ দিতে হবে। সেচটা সাধারণত খুব ভোরে অথবা সন্ধার আগে দেয়া ভালো। কারণ এসময় প্রচন্ড রোদে জমির মাটি গরম থাকে। ঐ অবস্থায় জমিতে সেচ দিলে চারার খুব ক্ষতি হয়। এইজন্য জমির মাটি ঠান্ডা থাকা অবস্থায় সেচ দেয়া ভালো। ১৫/২০ দিন পর চারা মাটিতে লেগে যায়, একটু বড়ও হয়। তখন গাছে ওষুধ এবং সার দেয়া ।

গাছকে তাড়াতাড়ি বৃদ্ধির জন্য ওষুধ দিতে হয়।

এ সময় মাটিতে জো হলে এবং আগাছা বেশি হলে নিড়ানী দিয়ে শুধু গাছের গোড়া এবং কোদাল দিয়ে সমস্ত জমি কুপিয়ে দিতে হয়। তারপর প্রতি বিঘা জমিতে ২০ কেজি হারে সার শুধু গাছের সারির মধ্য দিয়ে ছিটিয়ে দিয়ে সেচ দিতে হবে।

সেচ দেয়ার দুই তিন দিন পর যে জায়গার চারাগুলো মারা গেছে সেই জায়গা পূরণ করতে হবে। যে চারাগুলো অতিরিক্ত থাকবে এবং প্রত্যেক সারিতে লক্ষ্য করতে হবে সেখানে চারার পরিমাণ বা ঘনত্ব বেশি সেই জায়গা থেকে চারপাশের মাটিসহ চারা তুলে খালি জায়গায় লাগিয়ে দিতে হবে। কাজটা করতে হবে বিকালে।

কয়দিন পর চারা যখন একটু বড় হবে তখন গাছের গোড়ায় মাটি টেনে দিতে হবে। এ সময় অনেক গাছে কুঁড়ি আসবে। কুঁড়িগুলো ভেঙ্গে দিতে হবে। বৃষ্টিপাত না হলে মাটি বেশি শুকানোর আগেই সেচ দিতে হবে। গাছ যত বড় হবে গাছে ওষুধ এবং সার দেয়ার পরিমাণও বাড়াতে হবে। এছাড়া গাছের গোড়ায় মাটি বেশি দিতে হবে।

এ সময় গাছে পোকার আক্রমণ শুরু হয় এবং আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে। তাই এ সময় সপ্তাহে ২/৩ দিন ওষুধ দিহে হবে। বাজারে অনেক কীটনাশক ওষুধ পাওয়া যায়। ভালো মানের ওষুধ দিলে কাজ ভালো হয়।

প্রত্যেকটি গাছে কমপক্ষে ৫/৭ টি কুঁড়ি না হওয়া পর্যন্ত সব কুঁড়ি ভেঙ্গে দিতে হবে। আর কুঁড়ি থাকা অবস্থায় গাছে থিওভিট দেয়া বন্ধ করে দিতে হবে।

এ সময় থেকে নিয়মিত গাছকে পর্যবেক্ষণ করতে হবে এবং প্রয়োজনমতো গাছে ওষুধ দিতে হবে। সার দিতে হবে। এ সময় থেকে শুধু বাংলা ফসফেট সার দিতে হবে। নিয়মিত সেচ দিতে হবে। জমিতে ঘাস হলে নিড়িয়ে গোড়া বাঁধতে হবে।

এ সময়ই শনাক্ত করা যাবে পুরুষ ফুলের গাছগুলো। ফুল ফোটে না অর্থাৎ পাঁপড়ি হয় না। এ পুরুষ গাছগুলো তুলে ফেলতে হবে।

ফুল সংগ্রহ

সঠিকভাবে পরিচর্যা করলে গরম জাতীয় গাছ থেকে ৭৫/৮০ দিনের মধ্যেই ফুল সংগ্রহ করা সম্ভব। প্রথম অবস্থায় ফুলের আকার কিছুটা ছোট হবে। গাছটা যখন পরিপূর্ণ হবে তখন ফুলের আকার বড় হবে। আবার শেষের দিকে আকার ছোট হয়ে যাবে। যে ফুলগুলো পরিপূর্ণভাবে ফুটে যাবে সেগুলোকেই বিক্রির জন্য তুলতে হবে। ফুল তুলতে হবে ভোরে এবং রোদ বৃদ্ধি পাওয়ার আগেই তোলা শেষ করতে হবে। তোলার পর ফুলগুলোকে ঠান্ডা ও ছায়াযুক্ত স্থানে ছড়িয়ে রাখতে হবে। তারপর ঝোপা গেঁথে বিক্রি করতে হবে।

ফুলের বাজার সবসময় একরকম থাকেনা। প্রতিদিনই প্রায় বাজার উঠানামা করে।

ঝোপা করার পদ্ধতি

ফুলের ঝোঁপা করতে হলে দুইটা জিনিসের প্রয়োজন। পাটের দড়ি এবং সূঁচ। সূঁচ তৈরি করে নিতে সাধারণত সাইকেলের স্পোক দরকার হয়। সূঁচের এক মাথা খুব চিকন হবে এবং অন্য মাথা সূতা পরানোর জন্য মাঝখানে ছিদ্রযুক্ত হবে।

প্রথমে একটা লম্বা কাঠের দুই দিকে দুইটা পেরেক পুঁততে হবে ৪৮ ইঞ্চি দূরত্বে। এরপর সূতলীল সঙ্গে ধরে দুই পেরেকে ১০ বার পেঁচাতে হবে। অর্থাৎ দুই পাশে ১০টি করে মোট ২০টি সূতা হবে। এর পর হাতে ধরা পাশে পেরেকের কাছ থেকে সব সূতা কেটে দিতে হবে। তারপর অন্য প্রান্তের পেরেকের কাছ থেকে মাঝখানে সুতা ধরে দুই পাশে ৬ ইঞ্চি দূরত্বে ২টি গিরা দিতে হবে। তৈরি হয়ে গেল ঝোপা।

এরপর একটা করে সূতা সুচে পুরে সূতার গোড়ার দিকে ছোট সাইজের ফুল, মাঝে মাঝারি সাইজ এবং শেষে বড় সাইজের ফুল গেঁথে দিতে হবে এবং সূতার ২ ইঞ্চি পরিমাণ খালি রেখে আঙুল দিয়ে ঘুরিয়ে ফুলের মাঝখানে বসিয়ে দিতে হবে। অনুরূপভাবে প্রত্যেকটি সূতায় একই ভাবে ফুল গাঁথতে হবে।

সম্ভাব্য আয়-ব্যয়

বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে এক বিঘা জমিতে গরম ফুল চাষের সম্ভাব্য আয়-ব্যয়ের খসড়া হিসাব আপনাদের জ্ঞাতার্থে উপস্থাপন করা হল।

সম্ভাব্য ব্যয়

জমি চাষ- ৬০০ টাকা

সেচ- ৩,০০০ টাকা

চারা ক্রয়- ৪,০০০ টাকা

সার ও ওষুধ- ১২,৪০০ টাকা

শ্রমিক খরচ- ৭,০০০ টাকা

পরিবহন- ৩,০০০ টাকা

বিবিধ- ৫,০০০ টাকা

সর্বমোট= ৩৫,০০০ টাকা

সম্ভাব্য আয়

সঠিকভাবে পরিচর্যা করলে এক বিঘা জমি থেকে ফুল আসবে কমপক্ষে ১৪০০ ঝোঁপা। প্রতি ঝোঁপা ফুল যদি গড়ে ৪৫.০০ টাকা দরে বিক্রি করা হয় তাহলে মোট আয় হবে।

১৪০০×৪৫ = ৬৩,০০০ টাকা

সুতরাং সম্ভাব্য নীট লাভ হবে

৬৩,০০০-৩৫,০০০ = ২৮,০০০ টাকা

উল্লোখ্য,হিসেবে পরিচিত কাউকে দিয়ে করা বেন।

পরিশেষে একটা কথাই বলব, ফুল চাষি হতে হলে সবার আগে প্রয়োজন আগ্রহ। এরপর পরিশ্রম আর একাগ্রতা। প্রাথমিক অবস্থায় চাষিকে সাফল্য ও ব্যর্থতা গ্রহণ করার জন্য মাসসিকভাবে প্রস্তুত থাকতে হবে।

ফুল চাষের জন্য কোন প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রয়োজন হয় না, কম লেখাপড়া জানা যে কোন ব্যক্তিও হাতে কলমে শিক্ষা গ্রহণ করে ফুল চাষ শুরু করতে পারেন।
ফুলচাষে সফলতা পাওয়ার জন্য ফুল গাছকে নিজের সন্তানের মতো ভালোবাসতে হবে। লালন পালন করতে হবে।

নিজের সার্বিক তত্ত্বাবধানে রেখে একাগ্রতার সঙ্গে ফুল চাষে মনোনিবেশ করতে হবে। তাহলেই সাফল্য অবশ্যম্ভাবী।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

হোম
জয়েন গ্রুপ
স্থানীয় খবর
জয়েন গ্রুপ
গুগল নিউজ